The complete history of the Bangladesh Army is discussed in detail here , History of Bangladesh Army
সাধারণ বিষয় :
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর স্থল শাখা। এটি বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সর্ববৃহৎ শাখা। সেনাবাহিনীর প্রাথমিক দায়িত্ব হচ্ছে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের অখণ্ডতা রক্ষা সহ সব ধরনের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সহায়তায় প্রয়োজনীয় শক্তি ও জনবল সরবরাহ করা। সেনাবাহিনীর সব ধরনের কর্মকান্ড সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের সেনা শাখা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। প্রাথমিক দায়িত্বের পাশাপাশি যেকোন জাতীয় জরুরি অবস্থায় বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় এগিয়ে আসতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সাংবিধানিক ভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
প্রারম্ভিক ইতিহাস :
বাংলার সামরিক ইতিহাসের মূল রাজা-মহারাজাদের সময় পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। সেসময় সেনাবাহিনীর প্রধানকে সেনাপতি বা মহাসেনাপতি নামে ডাকা হত। সেই সব সেনাবাহিনী গঠিত হত পদাতিক, অশ্বারোহী, যুদ্ধ হাতি আর যুদ্ধজাহাজ নিয়ে। বাংলায় মুসলমানদের আগমন আর বাংলা সুলতানাত এর প্রতিষ্ঠা সামরিক বাহিনীকে আরও শক্তিশালী করেছিল। সুলতানাতের একটি সুসজ্জিত ও সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী ছিল। মুঘল শাসনের সময় বাংলায় কামান ও গোলন্দাজ বাহিনীর প্রচলন হয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সময় বাংলা ছিল দক্ষিণ এশিয় অঞ্চলে ব্রিটিশদের শক্তির প্রতীক। ১৭৫৭ সালে লর্ড ক্লাইভের নেতৃত্বাধীন ব্রিটিশ বাহিনী, নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার নেতৃত্বাধীন ৫০০০০ সৈন্যের বাংলার সেনাবাহিনীকে পলাশীর প্রান্তরে পরাজিত করে।পরবর্তীতে একই ব্রিটিশ বাহিনী ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে নবাব মীর কাসিমের নেতৃত্বাধীন বাংলার বাহিনীকে পরাজিত করে। ব্রিটিশরা বাংলায় আর্মি অফ বেঙ্গল প্রতিষ্ঠা করে যা পরবর্তীতে ১৮৯৫ সালে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর অংশ হয়ে যায়। ব্রিটিশ ভারতের পশ্চিম অংশ ছিল পুলিশ এবং সেনা সংগ্রহের জন্য অগ্রগণ্য অঞ্চল। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পূর্বে অশ্বারোহী বাহিনী এবং বল্লমধারী সৈন্যদলের সবাই ছিল এই অঞ্চলের।[৪][৫] বিদ্রোহের পর বেঙ্গল উপসর্গ-যুক্ত বিভিন্ন ইউনিটে, যেমন: বেঙ্গল স্যাপারস এবং বেঙ্গল ক্যাভালরি ইত্যাদি, বিহার, বানারসি, উত্তর প্রদেশ ইত্যাদি অবাঙ্গালি অঞ্চল থেকে নিয়োগ দেয়া হত কারণ এই অঞ্চলগুলো তখন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অধীনে ছিল।[৩][৬] প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বাংলা থেকে সৈন্য সংগ্রহের জন্য বেঙ্গলি পল্টন প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯১৬ সালে ব্রিটিশ সরকার বেঙ্গলি ডাবল কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে। এই সৈন্যদেরকে করাচিতে প্রশিক্ষণ দেয়া হত আর পরে বাগদাদে মোতায়েন করা হত। যুদ্ধ শেষে এই সৈন্যরা বাগদাদে ১৯১৯ সালের কুর্দি বিদ্রোহ দমনে সাহায্য করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ড পাইওনিয়ার কোর নামক একটি সহায়ক বাহিনী প্রতিষ্ঠা করে যারা ছিল কিছুটা প্রকৌশলী কিছুটা পদাতিক। এই বাহিনীর বেশিরভাগ সৈন্য সংগ্রহ করা হয়েছিল পূর্ব এবং পশ্চিম বাংলা থেকে। এই বাহিনী মূলত রাস্তাঘাট ও বিমানঘাঁটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইত্যাদি নির্মাণের মাধ্যমে মূল বাহিনীকে সাহায্য করত। তবে প্রয়োজনে তারা পদাতিক বাহিনী হিসেবে জাপানের সাথে যুদ্ধও করত। এই বাহিনীকে বিভিন্ন কোম্পানিতে সংগঠিত করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিভিন্ন রেজিমেন্টের সাথে সংযুক্ত করা হয়েছিল। ক্যাপ্টেন গনি ছিলেন একজন কোম্পানি কমান্ডার এবং তিনি বার্মা ফ্রন্টে তার বাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। যুদ্ধ শেষে পাইওনিয়ার কোরের সৈন্যরা ভারত ও জাপানের বিভিন্ন স্থানে সমবেত হয়ে বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় ছিল।
১৯৪৬ সালে, জালনায় অবস্থিত পাইওনিয়ার কোর সেন্টারের তৎকালিন অ্যাডজুট্যান্ট এবং কোয়ার্টারমাস্টার ক্যাপ্টেন গনি পূর্ব বাংলার যুদ্ধফেরত পাইওনিয়ার কোরের সৈন্যদের নিয়ে একটি পদাতিক রেজিমেন্ট তৈরির ধারনা দেন এবং কেন্দ্রীয় কমান্ডের কাছে অনুমতি প্রার্থনা করেন। পরবর্তীতে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয় এবং ভারত ও পাকিস্তান নামক নতুন দুই রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল স্যার ফ্রাংক মেজারভি এর অনুমতি পাওয়ার পর ক্যাপ্টেন গনি পূর্ববাংলার সৈন্যদের নিয়ে বাঙালি পল্টন গঠন করেন যা ছিল পরবর্তীতে গঠিত পদাতিক রেজিমেন্টের মূল ভিত্তি।
পাকিস্তান পর্ব :
পাকিস্তান সৃষ্টির সময় ক্যাপ্টেন আব্দুল গনি পাকিস্তানের নবনিযুক্ত সেনাপ্রধান জেনারেল মেজারভির অনুমতি নিয়ে পূর্ববাংলার যুবকদের নিয়ে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠনের কাজ শুরু করেন। ১৯৪৭ সালের ১৭ আগস্ট বোম্বেতে পাইওনিয়ার কোরের সৈন্যদের বিদায় অনুষ্ঠানে ক্যাপ্টেন গনি বলেন "তোমরা পৃথিবীর কাছে প্রমাণ করে দেবে বাঙালি সৈন্যরা পৃথিবীর অন্যান্য জাতির মতই সক্ষম"। উৎসাহব্যঞ্জক কথার সাথে ক্যাপ্টেন গনি ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দুইটি পাইওনিয়ার কোম্পানি নিয়ে ঢাকায় ফিরে পিলখানায় (বর্তমান বিজিবি হেডকোয়ার্টার্স) অবস্থান নেন। পরবর্তীতে তিনি প্রশাসনের কাছে সৈন্যদের উপযুক্ত আবাসস্থল চান। তিনি রাজধানীর উত্তর দিকের কুর্মিটোলাকে সেনানিবাসের উপযুক্ত স্থান হিসেবে চিহ্নিত করেন। দিনের পর দিন পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে এখানে জংগল পরিষ্কার করে ব্যারাক, প্যারেড গ্রাউন্ড ইত্যাদি গড়ে তোলা হয়।
১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পথিকৃৎ, ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর পতাকা উত্তোলন করা হয়। ক্যাপ্টেন গনি ছিলেন এই ব্যাটালিয়নের সবকিছুর প্রধান তবে প্রথম কমান্ডিং অফিসার ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল ভি জে ই প্যাটারসন।[৩] এবং অফিসার কমান্ডিং ছিলেন মেজর আব্দুল ওয়াহেদ চৌধুরী প্রথম ব্যাটালিয়নের গঠনের পর দ্বিতীয় ব্যাটালিয়ন স্থাপনের অনুমতি দেয়া হয় এবং ক্যাপ্টেন গনি সৈন্য সংগ্রহ শুরু করেন। ৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৯ ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পতাকা উত্তোলিত হয়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের আগে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মোট ৮টি ব্যাটালিয়ন গঠিত হয়।
১৯৭১: স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্ম
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এর
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদান :
১৯৭০ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমান এর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। কিন্তু ক্ষমতায় থাকা সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায় যার ফলস্বরূপ অসন্তোষ ছড়িয়ে পরে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট শুরুর মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক জনগণের উপর ঝাঁপিয়ে পরে। পাকিস্তানি বাহিনী এবং এর সহযোগী আধাসামরিক বাহিনী হাজার হাজার সামরিক-বেসামরিক মানুষ হত্যা করে।
২৬ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান এর পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা প্রদান করে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান। মার্চ মাসেই ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যরা বিদ্রোহ করে এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। পরবর্তীতে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) সৈন্যরাও সশস্ত্র প্রতিরোধে অংশ নেয়। সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি বেসামরিক জনগণ মিলে গড়ে তোলে মুক্তিবাহিনী। ১৭ এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয় এবং কর্ণেল (অব:) মহম্মদ আতাউল গণি ওসমানীকে বাংলাদেশ বাহিনীর নেতৃত্বদানের দায়িত্ব দেয়া হয়।
১৯৭১ সালের ১১-১৭ জুলাই সেক্টর কমান্ডার্স কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। এই কনফারেন্সে লে: কর্ণেল আব্দুর রবকে চিফ অফ স্টাফ, গ্রুপ ক্যাপ্টেন একে খন্দকারকে ডেপুটি চিফ অফ স্টাফ এবং মেজর এ আর চৌধুরীকে অ্যাসিস্ট্যান্ট চিফ অফ স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব দিয়ে বাংলাদেশ বাহিনী কমান্ড প্রতিষ্ঠিত হয়। কনফারেন্সে বিভিন্ন সেক্টরের গঠন এবং বিন্যাস, সেক্টরের সমস্যা, বিভিন্ন কৌশলগত দিক এবং বাংলাদেশ বাহিনীর জনবল বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা হয়। এই কনফারেন্সে বাংলাদেশকে এগারটি সেক্টরে ভাগ করা হয় এবং প্রত্যেক সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার নিয়োগ দেয়া হয়।[৩][৮] সেক্টরের সকল কর্মকাণ্ড সেক্টর কমান্ডার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত। নিয়ন্ত্রণের সুবিধার্থে কিছু সেক্টরকে একাধিক সাব-সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল। ১০ নম্বর সেক্টর ছিল সরাসরি বাংলাদেশ বাহিনীর প্রধানের অধীনস্ত এবং এই সেক্টরের জনবল ছিল প্রধানত নৌ কমান্ডোগণ।
কনফারেন্সের পর বাংলাদেশ বাহিনী একটি দীর্ঘমেয়াদী গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে। পরবর্তীতে বাহিনীকে আবার পুনর্গঠন করা হয় এবং তিনটি ব্রিগেড আকারের সৈন্যদলে ভাগ করা হয়:
কে ফোর্স, মেজর খালেদ মোশাররফ এর নেতৃত্বাধীন, ৪, ৯ ও ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে গঠিত।
এস ফোর্স, মেজর কেএম শফিউল্লাহর নেতৃত্বাধীন, ২ ও ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে গঠিত।
জেড ফোর্স, মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন, ১, ৩ ও ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে গঠিত।
২১ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ বাহিনীর সামরিক সদস্যদের নিয়ে। প্রতিষ্ঠার পর মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যুদ্ধের পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনী প্রথাগত যুদ্ধ শুরু করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ এবং ভারতের যৌথ বাহিনীর কাছে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ৯ মাসব্যাপী চলা স্বাধীনতা যুদ্ধের অবসান ঘটে এবং স্বাধীন বাংলাদেশ শত্রু মুক্ত হয়।
0 Comments